Friday, September 2, 2016

হাসি ফোটাবে হাঁসের খামার

আমাদের দেশের আবহাওয়া হাঁস পালনে খুবই উপযোগী। সমস্যা হচ্ছে হাঁসের মাংস ও ডিম মুরগির মাংসের চেয়ে জনপ্রিয় কম। তবে বর্তমানে এটি অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এখন হাঁস চাষ লাভজনক একটি প্রযুক্তি। অনেকেই
বাণিজ্যিকভাবে হাঁস চাষে এগিয়ে আসছেন এবং প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন হাঁস চাষ। মৎস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, পুকুরে হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করলে খুব সহজে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। হাঁস চাষে অনেক সুবিধা রয়েছে যেমন- মাছের জন্য পুকুরে তেমন বাড়তি সার ও খাদ্য দিতে হয় না । হাঁস থাকলে মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
হাঁস পালনে সুবিধা: 
হাঁসের রোগবালাই তুলনামুলক খুবই কম। তাছাড়া খাবারের তেমন অভাব হয় না। উন্নত জাতের হাঁস বছরে ২৫০-৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে।
যেভাবে শুরু করতে পারেন: 
প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে চাইলে আপনার ৪০-৫০ শতাংশ আয়তনের একটি পুকুর লাগবে। ১০০-২০০টি হাঁস এবং হাঁসের ঘর তৈরি করে নিতে হবে। এসব পরিকল্পিতভাবে করলে ভালো হবে।
উন্নত হাঁসের জাত: 
হাঁসের জাত নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যে জাতের হাঁস বেশি ডিম দেয় সে জাতের হাঁস নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে সিলেট নাগেশ্বরী (নাগিনী) ও মিটি, খাকি ক্যাম্পেবেল, ইন্ডিয়ান রানার জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। এ জাতের হাঁস ৫ মাস বয়স থেকে টানা তিন বছর প্রায় নিয়মিত ডিম দেয়। নাগিনী ও খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁস বছরে ২৮০-৩০০ ডিম 
পালন পদ্ধতি
হাঁস পালনে তেমন শ্রম দিতে হয় না। বাইরে ছেড়ে দিলে নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করতে পারে। অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মেটাতে চালের কুঁড়ার সঙ্গে ডি, ই, বি-১, বি-২, বি-৬, বি-১২ ভিটামিন দেওয়া যেতে পারে। হাঁস সাধারণত পাঁচ মাস বয়সে ডিম দেওয়া শুরু করে। পূর্ণ মাত্রায় ডিম দেয় তিন বছর বয়স পর্যন্ত। এরপর হাঁসগুলোকে বাজারে বিক্রি করে দিতে পারেন, যার মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
যেভাবে হাঁস পালন করবেন: 
হাঁস বিভিন্ন পদ্ধতিতে পালন করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন। এ পদ্ধতিতে ২৫-১০০টি হাঁস মুক্ত পুকুরে, লেকে অথবা ধান কাটার পর পরিত্যক্ত জমিতে পালন করা যায়। অপরটি হচ্ছে ইনটেনসিভ হাঁস পালন। এ পদ্ধতিতে ১-১০ লাখ হাঁস পালন করা সম্ভব। দিনের বেলায় হাঁস পানিতে থাকতে পছন্দ করে। শুধু রাতযাপনের জন্য ঘরের প্রয়োজন।
হাঁসের ঘর তৈরি:
পুকুরপাড়ে কিংবা পুকুরের ওপর ঘরটি তৈরি করতে হবে। ঘরের উচ্চতা ৫-৬ ফুট হলে ভালো হয়। ঘর তৈরিতে বাঁশ, বেত, টিন, ছন, খড় ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ইট দিয়ে মজবুত করে ঘর তৈরি করতে পারলে ভালো হবে। ঘরটি খোলামেলা হতে হবে এবং সাপ ও ইঁদুর থেকে মুক্ত রাখতে হবে। শহরে বিভিন্ন মাপের চৌবাচ্চায় হাঁস পালন করা হচ্ছে । এক্ষেত্রে প্রশস্ত ছাদ থাকলে সুবিধা বেশি। ছাদের একপাশে ঘর অপর পাশে চৌবাচ্চা নির্মাণ করতে হবে। প্রজননের জন্য আটটি হাঁসের সঙ্গে একটি পুরুষ হাঁস রাখা দরকার। এরপর দেশি মুরগির সাহায্যে অথবা ইনকিউবেটরে হাঁসের ডিম ফোটানো যায়। 
কোথায় পাবেন হাঁসের বাচ্চা:
দৌলতপুর হাঁস খামার, নারায়ণগঞ্জ হাস প্রজনন কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত হাঁস-মুরগির খামার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাঁস বা হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করতে পারেন।
হাঁসের খাদ্য:
হাঁস চাষে সুবিধা হলো হাঁস খাল-বিল-পুকুর থেকে তার কিছু খাবার সংগ্রহ করে নেয়। তাছাড়া বাজারে হাঁসের তৈরি খাবার কিনতে পাওয়া যায়। শুকনো খাদ্য না দিয়ে হাঁসকে সবসময় ভেজা খাদ্য দেয়া উচিত। খাদ্যে আমিষের পরিমাণ ডিম দেয়া হাঁসের ক্ষেত্রে ১৭-১৮ শতাংশ ও বাচ্চা হাঁসের ক্ষেত্রে ২১ শতাংশ রাখা উচিত। হাঁস দানা, খইল, ভূষি, ঝিনুকের গুঁড়ো, ডিমের খোসা, কেঁচোসহ অন্যান্য খাবার বেশি পছন্দ করে।  
মাছের পুকুরেও হাঁস পালন:
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাছের পুকুরে হাঁস পালন করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হন। এ চাষে হাঁস বেশি প্রোটিন পায়। মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়
হাঁসের খাবার
খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁস পুকুর/জলাশয়ে ছেড়ে পুষলে খাবারের অনেক সাশ্রয় হয়। কারণ হাঁস তখন জলজ উদ্ভিদ কীট- পতঙ্গ, মাছের ডিমপোনা, গুগলি, শামুক, গেড়ি খেয়ে বেড়ায়। কিন্তু ঘেরার মাঝে হাঁস পালন করলে তখন তাকে পুরো খাবারই খাওয়াতে হবে। পুরো ৮ সপ্তাহের জন্য হাঁস পিছু লাগবে ৪/৫ কেজি সুষম খাদ্য এবং ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত সেটা দাঁড়বে সাড়ে বরো কেজি।
পুর্ণবয়ষ্ক হাঁস হড়ে দিনে ১৩০ থেকে ১৫০ গ্রাম সুষম খাদ্য খায়। খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁসকে সর্বদা সুষম খাদ্য ভিজিয়ে খাওয়াতে হবে। এই ব্যবস্থায় খাবারের অপচয় কম হয় এবং হাঁস চট করে গিলে নেয়।
খাঁকি ক্যাম্পবেল হাঁসের দৈনিক খাবার দেওয়ার হার নিচে দেয়া হলো:
০-৪ সপ্তাহ - দৈনিক ৪ বার।৪-৮ সপ্তাহ - দৈনিক ৩ বার।৮ সপ্তাহের উপর - দৈনিক ২ বার।
থাকার জায়গার পরিমাণ:
০-২ সপ্তাহ আধা ইঞ্চি বাচ্চা প্রতি।২-৪ সপ্তাহ ১ ইঞ্চির ৪ ভাগের ৩ ভাগ বাচ্চা প্রতি। ৪-৭ সপ্তাহ দেড় ইঞ্চি বাচ্চা প্রতি।
হাঁসের সুষম খাবারের তালিকা:
ঠিক সময়ে ডিম পাওয়ার জন্য ক্যাম্পবেল হাঁসের সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। খামারকারী নিজেও এই সুষম খাদ্য নিজে তৈরি করে নিতে পারে। এতে দামে যেমন সস্তা হয়, এবং নিজেও প্রচন্ড বল পেতে পারেন যে তিনি তাঁর হাঁসকে ভাল খাবার খাইয়াছেন।
সুষম খাদ্য তৈরির নিয়ম নিচে দেয়া হলো-
প্রতি ১০০ ভাগ খাবারের মধ্যে-গম - ৩০ ভাগ;ধান ভাঙ্গা - ৪০ ভাগ;কালো তিল খোল - ১০ ভাগ;সয়াবিন খোল - ১০ ভাগ;শুঁটকি মাছের গুঁড়ো - ৮ ভাগ;ঝিনুক ভাঙ্গা - ২ ভাগ।
ভিটামিন এ, বি২, ডি৩, ই, কে প্রতি ১০০ কেজি খাবারের ১০ গ্রাম মেশাতে হবে এবং প্রতি কু্যইন্টাল হিসেবে কোলিন ক্লোরাইড দিতে হবে ৫০ গ্রাম। হাঁস ৬ -৮ সপ্তাহ হলে গমের পরিমান কমিয়ে ছত্রাক মুক্ত মেশানো যেতে পারে। কোলিন ক্লোরাইড যেমন দিতে হবে বৃদ্ধির জন্য তেমনি ককসিডিয়া রোড় বন্ধ করার জন্য দিতে হবে ককসিডিওস্ট্যাট।
ককসিডিওস্ট্যাট দিতে হবে হাঁসের ১২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত। মেশাবার হার প্রতি ১০০ কেজি খাবারের জন্য ৫০ গ্রাম। হাঁসকে গুগলি দিলে শুঁটকি মাছের পারিমান কমিয়ে দিতে হবে। এতে খাবারের দাম ও কমে যাবে।
প্রশিক্ষণ:
বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় হাঁস প্রজননকেন্দ্র আছে নারায়ণগঞ্জে। এখান থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। আরো প্রজননকেন্দ্র আছে খুলনার দৌলতপুর, নওগাঁ, ফেনীর সোনাগাজী, কিশোরগঞ্জ ও রাঙামাটিতে। প্রশিক্ষণ নিতে পারেন আপনার কাছাকাছি কেন্দ্র থেকে। এসব কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করতে পারেন প্রয়োজনীয় হাঁসের বাচ্চা। হাঁসের খাবার ও ওষুধপত্র কিনতে পাওয়া যাবে প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় শহরেই। ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় আছে পাখির খাদ্যের বৃহৎ বাজার। চালের মিল থেকে তুষ ও কুঁড়া সংগ্রহ করা যাবে। এ ছাড়া পশুখাদ্য দোকানে তুষ ও কুঁড়া
রোগব্যাধি:
হাঁসের প্রধান রোগ কলেরা ও প্লেগ। হাঁসকে এসব রোগ থেকে রক্ষা করতে কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। ধানের তুষ দিয়ে বানানো হাঁসের বিছানায় প্রতিদিন ব্লিচিং পাউডার এবং ভিরকন-এস প্রয়োগ করতে হবে।

ভয় পেলে হাঁসের ডিম পাড়ায় বিঘ্ন ঘটে। তাই সব সময় খেয়াল রাখতে হবে, হাঁসগুলো যেন কোনোভাবেই ভয় না পায়। এক দিন থেকে দুই মাস বয়সের মধ্যে দুবার প্লেগ ও কলেরার টিকা দিতে হবে। এরপর প্রতি ছয় মাস পর পর টিকা দিতে হবে। সরকারি দপ্তর থেকে টিকার ভ্যাকসিন কেনাই ভালো। ভ্যাকসিন কেনার সময় দেখে নিতে হবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না। সঠিকভাবে পরিবহন না করলে ভ্যাকসিনের গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে।