Wednesday, August 17, 2016

টমেটো চাষ - ৫০ শতক জমিতে আয় ৫ লাখ টাকা

আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রম যে কোনো মানুষকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে, এরকমই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামের শিক্ষিত যুবক রবীন্দ্র মোহন চৌধুরী রবি।
বিদেশে যাওয়ার জন্য ধারদেনা করে দালালদের দুবার মোটা অঙ্কের টাকা দেন। কিন্তু দালালরা সেই টাকা মেরে দেয়। দেনা শোধ করতে গিয়ে রবি মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তার পরও দমে যাননি রবি। সেই ক্ষতি পুষিয়ে রবি এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সার্বিক সহায়তায় আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ।

গত বছর ৪৫ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের টমেটো চাষ করে খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৪ লাখ টাকা আয় করেছেন। চলতি বছর ৫০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের (এপক্স ও ইএস) টমেটো চারা চাষ করেন। তাতে তার খরচ হয় ৮০ হাজার টাকা। এবার প্রতি গাছে ফলন হয়েছে ১০-১২ কেজি টমেটো। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার বাম্পার ফলন দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। এবার টমেটো বিক্রি করে খরচ বাদে তার প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে। এ বছর টমেটোর ওজন হয়েছিল ১৫০-২০০ গ্রাম পর্যন্ত। রবির এই সাফল্য দেখতে পার্শ¦বর্তী এলাকার লোকজন প্রতিদিন ভিড় জমান।

সফল টমেটো চাষি রবি বলেন, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অরুণ চন্দ্র কর ৫-৬ দিন পরপর আমার চাষকৃত জমি সরজমিন দেখতে আসতেন। কীভাবে জমির পরিচর্যা করলে আরো বেশি লাভবান হওয়া যায় সেই পরামর্শ দিতেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাধন কুমার গুহ জানান, রবির এই অভাবনীয় সাফল্য এলাকার যুবসমাজ ও চাষিদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে।

সারা বিশ্বে আলুর পরই টমেটো উৎপন্ন হয়। অধিকাংশ দেশেই টমেটো অন্যতম প্রধান সবজি। টমেটো কাঁচা, পাকা এবং রান্না করে খাওয়া হয়। প্রতি মৌসুমে বিপুল পরিমাণ টমেটো সস, কেচাপ, চাটনি, জুস, পেষ্ট, পাউডার ইত্যাদি তৈরিতে ব্যহৃত হয়। টমেটোর কদর মূলত ভিটামিন-সি এর জ 
ন্য। তবে এর রঙ, রূপ ও স্বাদও অনেককে আকৃষ্ট করে। সালাদ হিসেইে অধিকাংশ টমেটো খাওয়া হয়।


টমেটোর জাত :গ্রীষ্মকালীন জাত : বারী টমেটো ৪, ৫, ৬ ও ৯।
শীতকালীন জাত : বারী টমেটো ১, ২, ৩, ৬, ৭ ও ১০।

বীজ কোথায় পাবেন : 

-কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যান নার্সারি রংপুর অঞ্চলের দিনাজপুর ও বুড়িরহাট, রংপুরে দুটো উদ্যান নার্সারি আছে সেখানেও যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।
-বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জয়দেবপুর, গাজীপুরও যোগাযোগ করে বীজ চারা সংগ্রহ করতে পারেন।
-বিশ্বস্ত কোনো বীজ বিক্রয় কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করতে পারনে।

আবাদ :
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ভালো ফলন পেতে টমেটোটোন নামক হরমোন প্রতি লিটার পানিতে ২০ মি.লি. মিশিয়ে ফুলে স্প্রে করতে হবে। দোআঁশ মাটি টমেটোর উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী। সমান জমির চেয়ে বেড করে টমেটো আবাদ করলে বেশি ফলন পাওয়া যায়। বেড ২০ থেকে ২৫ সে.মি. (৮ থেকে ১০ ইঞ্চি) উঁচু করতে হবে। প্রতি বেডে দুই সারি করে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সে.মি. (দুই ফুট) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪০ সে.মি. (১৬ ইঞ্চি) রেখে ২৫ থেকে ৩০ দিন বয়সী চারা লাগাতে হবে। শীতকালে মধ্যকার্তিক থেকে পৌষ পর্যন্ত এবং গ্রীষ্মকালে চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। প্রতি শতকের জন্য যে পরিমাণ সারের প্রয়োজন হয় তাহলে ইউরিয়া ২.০ থেকে ২.৫ কেজি, টিএসপি ১.৫ থেকে ২.০ কেজি, এমপি ১.০ থেকে ১.২৫ কেজি এবং জৈব সার ৪০ থেকে ৫০ কেজি। টমেটো গাছে ঠেকনা দিতে হয় এবং পাশের কুশিসহ মরা পাতা ছেটে দিতে হয়।


টমেটোর সমন্বিত সার ব্যবস্খাপনা:

নানা কারণে বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টমেটোর হেক্টরপ্রতি ফলন অনেক কম। বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ, উচ্চফলনশীল জাতের চাষ না করা, সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ না করা এবং ফসলের সঠিক পরিচর্যা না করা টমেটোর ফলন কম হওয়ার অন্যতম কারণ। উন্নত জাত চাষ করে সঠিক সার ব্যবস্খাপনার মাধ্যমে টমেটোর ফলন গড় ফসলের চেয়ে সর্বোচ্চ ১০ গুণ বাড়ানো যে সম্ভব সেটা বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জৈব ও অজৈব সারের ব্যবস্খাপনার মাধ্যমে পরপর তিন বছর ফলন পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন। জৈব সার হিসেবে তারা ব্যবহার করেছিলেন গোবর সার ও হাঁস- মুরগির বিষ্ঠা। সাথে সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক সার। 

রাসায়নিক সারের সাথে জৈব সার একত্রে প্রয়োগের ফলে তারা দেখতে পানন্ধ টমেটোর ফল অনেক বেড়েছে এবং আকারও অনেক বড় হয়েছে। কাজেই টমেটো ফসলে সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্খাপনার মাধ্যমে ফলনকে বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য টমেটো ফসলে কোন পুষ্টির অভাবে কেমন লক্ষণ হয়, তা জানা দরকার।


নাইট্রোজেনের অভাবজনিত লক্ষণ:

গাছের পাতা বড় হয় না এবং রঙ হালকা সবুজ থেকে হলদে সবুজ হয়ে যায়, শেষে পাতা হলুদ হয়ে যায়। ডগার পাতা সবুজ থাকে কিন্তু কাছে বা নিচে থাকা পাতাগুলো হলদে সবুজ হয়ে যায়। কাণ্ড শক্ত ও মোটা হয়ে যায়। ফল কম ধরে এবং সেগুলো আকারে বড় হয় না।


ফসফরাসের অভাবজনিত লক্ষণ :

গাছ ধীরে বাড়ে এবং টমেটো পাকতে দেরি হয়। চারা অবস্খায় অভাব হলে চারা বসে পড়ে আর বাড়তে চায় না। শীতকালে এ সমস্যা বেশি হয়।


পটায়িামের অভাবজনিত লক্ষণ :

গাছ খাটো হয়ে যায়। কম বয়সী গাছের পাতা গাঢ় সবুজ রঙ ধারণ করে, মচমচে হয়ে কুঁকড়ে যায়। বয়স্ক পাতায় হলদে ছোপ দেখা যায় ও পাতা তামাটে রঙ ধারণ করে। পাতার কিনারা বাদামি হয়ে শুকাতে শুরু করে এবং ছিঁড়ে যায়। ডালের আগা অনেক সময় গুচ্ছাকার হয়ে যায় ও পাতার বোঁটা খাটো হয়ে আসে। ফল পাকতে শুরু করলেই ঝরে যায়।

দস্তার অভাবজনিত লক্ষণ :

তরুণ টমেটো গাছের পাতা ছোট হয়ে যায় এবং পাতার শিরার মধ্যবর্তী স্খানগুলো হলদে ফোঁটা ফোঁটা ছোট দাগ পড়ে। পাতা নিচের দিকে কুঁকড়ে যায়। গাছ খাটো হয়ে যায়।

সালফারের অভাবজনিত লক্ষণ:

পাতার রঙ ফ্যাকাশে হলুদ হতে শুরু করে এবং পরে অন্যান্য পাতা হলুদ হয়।

বোরনের অভাবজনিত লক্ষণ :

ডগা ভেতরের দিকে কুঁকড়ে শুকিয়ে যায় এবং মরে যায়। পাতা ছোট হয়ে যায়, কুঁকড়ে যায় এবং খানিকটা জায়গা ধরে বিবর্ণ হয়ে যায়।

ম্যাগনেসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ:

পাতার শিরাগুলো সবুজ থাকলেও শিরা-মধ্যবর্তী জায়গাগুলো হলুদ হয়ে যায়।

ম্যাঙ্গানিজের অভাবজনিত লক্ষণ :

নতুন পাতায় আন্ত:শিরা ক্লোরোসিস হয় অর্থাৎ শিরার মধ্যবর্তী স্খানগুলো হলদে হয়ে যায়। পাতা ধীরে ধীরে মরে যায়। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও ডগার পাতা গুটিয়ে যায়।

ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ :

বিকৃত অঙ্গ তৈরি হতে থাকে। অভাবী চারার পাতাগুলো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে থাকে এবং পাতার কিনারা পুড়ে যায়। গাছ খাটো হয়ে যায় ও ডগার বৃদ্ধি কমে যায়।

আয়রনের অভাবজনিত লক্ষণ : 

পাতার গোড়া থেকে হলদে ছিট ছিট দাগ পড়তে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে আগার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাতার মাঝ শিরা ও কিনারা বরাবর এ লক্ষণ বেশি দেখা যায়।

ক্লোরিনের অভাবজনিত লক্ষণ : 

ক্লোরিনের অভাবে তিন থেকে চার সপ্তাহ বয়সী গাছ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে গাছের শাখার বৃদ্ধি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় এবং শেকড়ের বৃদ্ধি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কম হয়। পাতা কম হয়, ছোট হয় ও পাতার কিনারা কুঁকড়ে ও কুঁচকে যায়। শেকড় ছোট হতে থাকে এবং চারা টান দিয়ে মাটির উপরে তুললে শেকড় মাছের কাঁটার মতো দেখায়।

সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্খাপনার কিছু পরামর্শ :

জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সার সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ করুন। টমেটোর জমিতে সাধারণভাবে হেক্টর প্রতি ২৬০ কেজি ইউরিয়া, ২৮০ কেজি টিএসপি, ২২০ কেজি এমওপি, ৮০ কেজি জিপসাম, ১২ কেজি জিঙ্ক সালফেট, ৭ কেজি বোরিক অ্যাসিড পাউডার, ৩ কেজি ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, ৫ হাজার কেজি জৈবসার ও ৪০০ কেজি সরিষার খৈল দিলে ফলন ভালো হয়। সম্ভব হলে জমির মাটি পরীক্ষা করে বা কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের ভিত্তিতে হিসেব করে রাসায়নিক বা বাজারের সারের মাত্রা নির্ধারণ করুন। জমিতে গোবরের চেয়ে মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করা উত্তম। মুরগির বিষ্ঠা বা জৈবসার প্রয়োগ করলে তা থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদানের সমপরিমাণ রাসায়নিক সার কম দিন। নাইট্রোজেন সার তিন থেকে চার কিস্তিতে প্রয়োগ করুন। সার প্রয়োগের পর সেচ দিন। বিভিন্ন অণুুখাদ্যের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দিলে অণুখাদ্য সার পানিতে গুলে পাতায় স্প্রে করুন। যেমন- ম্যাঙ্গানিজের অভাব হলে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪৫ থেকে ৫০ গ্রাম ম্যাঙ্গানিজ সালফেট গুলে টমেটো গাছে স্প্রে করবেন। তেমনি বোরনের অভাব হলে প্রতি ১০লিটার পানিতে ১০ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড পাউডার গুলে গাছে স্প্রে করবেন। কপারের অভাবে গাছ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম কপার সালফেট বা তুঁতে গুলে রোপণের আগে চারার শেকড় ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখবেন। একই ভাবে চারার গোড়া প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম জিঙ্ক অক্সাইড গুলে তাতে চারা রোপণের আগে ঘন্টাখানেক ভিজিয়ে রাখলে সেসব গাছে আর জিঙ্কের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয় না। জিঙ্ক ফসফরাস ও জিঙ্ক সালফারের যৌথ ক্রিয়া ক্ষতিকর। তাই এ দু’টি সার জমিতে একসাথে না দিয়ে আলাদা প্রয়োগ করতে হবে। আবার কিছু কিছু পুষ্টি উপাদানের সাথে জিঙ্কের যৌথ ক্রিয়া বেশি কার্যকরী। যেমন- পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বোরন, মলিবডেনাম, নাইট্রোজেন ইত্যাদি।

কোথায় প্রশিক্ষণ নেবেন :টমেটোর আবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ অথবা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আপনি আপনার নিকটস্খ উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন। তা ছাড়া আপনার নিকটস্খ উপজেলার যুব উন্নয়ন অধিদফতরের যুব উন্নয়ন অফিসে যোগাযোগ করেও এ জাতীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবেন ।

লেখা এবং ছবিকালেক্টেড

No comments:

Post a Comment